বৈদ্যুতিক মোটর কি ও মোটরের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি

4
11611
বৈদ্যুতিক মোটর কি ও মোটরের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি
বৈদ্যুতিক মোটর কি ও মোটরের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি

সূচনাঃ

মোটরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি নিয়ে আজকের এই লেখা। জানতে পারবো মোটর কি, মোটর কত প্রকার, মোটর কিভাবে কাজ করে, ডিসি মোটর কিভাবে কাজ করে, এসি মোটর কত প্রকার ইত্যাদি সম্পর্কে। চলুন পাঠক দেরি না করে শুরু করি।

মোটর কিঃ

মোটর কি? সাধারণ কথায় যা দিয়ে আমরা বাসাবাড়িতে পানি তুলি, তাকেই মোটর বলে ডাকি (ক্ষেত্র বিশেষে পাম্প ও বলে)। হ্যাঁ, অনেকটা এরকমই। কিন্তু কিসের জন্য আমরা একই জিনিস কে দুইটি ভিন্ন নামে ডাকি? যেমন একটা জেনারেটর আর আরেকটা মোটর?

একে আমরা এ জন্যই মোটর বলে ডাকি কারণ এই যন্ত্রটি ইলেকট্রিক শক্তি কে মেকানিক্যাল শক্তিতে পরিণত করে। অর্থাৎ আমরা একে চালাতে ইনপুট হিসেবে দিচ্ছি বৈদ্যুতিক শক্তি আর আউটপুটে আমরা এর দ্বারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিয়ে নিতে পারছি। অর্থাৎ, মেশিনের যে দুটি ভাগের কথা বলেছিলাম একটি মোটর আর আরেকটি জেনারেটর, সেই দুটির মধ্যে এটিই হল মোটর, যা কিনা ইলেকট্রিক্যাল শক্তিকে মেকানিক্যাল শক্তিতে পরিণত করতে পারে এবং আমাদের দৈনন্দিন কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে।

মোটরের প্রকারভেদঃ

প্রধানত মোটরকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়, যথাঃ

ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ আগ্রহীদের জন্য মোটর সম্পর্কে জানা খুবই প্রয়োজন।  বিশেষ করে যাদের রোবট  ও রোবোটিক্স এর উপর কাজ করার ইচ্ছা। কারণ রোবটের মুভমেন্ট কন্ট্রোলিং এরজন্য ভিন্নভিন্ন মোটর ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। নামেই পরিচয় বিধায় এসি মোটর আর ডিসি মোটর এর ব্যাখ্যায় গেলাম না।

এছাড়াও ইন্ডাকশন মোটরসিনক্রোনাস মোটর প্রভৃতি বিভিন্ন ভাগে ভাগকরা যায়, তবে তা নিয়ে আজ লিখবো না। সামনে কোনো এক লেখায় ইন্ডাকশন মোটর, সিনক্রোনাস মোটর সহ আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলবো।

মোটরের কন্সট্রাকশন বা গঠনঃ

আসলে গঠন প্রনালী নিয়ে এক্সট্রা কিছু বলার দরকার পড়েনা। কারন ডিসি মোটর আর ডিসি জেনারেটর এর গঠন প্রনালী প্রায় একই। খুব বেশি পার্থক্য বা এক্কেবারেই কোন পার্থক্য নেই বলা চলে। তবে ডিসি মোটর আর ডিসি জেনারেটর এর কাজের ধরনে আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে। দুটিরই কাজ পুরোপুরি ভিন্ন। তবে মোটরের ক্ষেত্রে আরও অতিরিক্ত বিষয় আছে যেগুলো এখন আলোচনা করব।

মোটর, জেনারেটর এবং মেশিন নিয়ে আমার পূর্বের লেখাটি পড়তে সুহৃদ পাঠকদের কে অনুরোধ রাখছি

মোটরের টর্ক কিঃ

মোটরের টর্ক(Torque) এর কথা আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি। তার পরেও আবার ঝালাই করে নেই সহজ কয়েকটি কথায় যা মনে থাকবেই। ধরুন, আমরা সবাই কমবেশি বাসে উঠেছি। এখন সবাই হয়ত খেয়াল করেছি যে বাস থেমে থেকে যদি হঠাত করে চলতে শুরুকরে তাহলে যাত্রী যারা থাকেন তারা একটু পিছনের দিকে পিছিয়ে যান বা উলটো দিকে একটি ধাক্কা খান। আবার, যদি নৌকা পানিতে থাকা অবস্থায় সেখান থেকে স্থলে লাফ দেওয়া হয় তাহলে নৌকা পিছনের দিকে একটু পিছিয়ে যায়। কিন্তু কেন?

হ্যা, ঠিক ধরেছেন। এটিই সহজ কথায় টর্ক বলাযায়। তবে টর্কের একদম সঠিক সন্ধিবিচ্ছেদ হলঃ শক্তি x কৌণিক দূরত্ব । অর্থাৎ, বিপরীত দিকে উতপাদিত শক্তির পরিমান কে তাদের আভ্যন্তরীন কোণ দিয়ে গুন করলে যে মান পাওয়া যাবে তাকে টর্ক বলে। আহ, একটু বলতে বলতে পুরো মহাভারত বলে ফেললাম। আচ্ছা এবার বিপরীত ভোল্টেজ/Back EMF এর কথায় আসি যা মূলত টর্কের কারণেই সৃষ্টিহয়।

মোটরের টর্ক কিভাবে সৃষ্টি হয় তার সরল এনিমেশন চিত্র
মোটরের টর্ক কিভাবে সৃষ্টি হয় তার সরল এনিমেশন চিত্র

মোটরের বিপরীত ভোল্টেজ বা Back EMF:

এখন কথাহলো ব্যাক ভোল্টেজ জিনিস টা কি? একই জিনিস কিন্তু একটুখানি ভিন্ন কথা। থিওরি হিসেবে বলতে গেলে বলতে হবে, ”বিপরীত ভল্টেজ হল সেই ভোল্টেজ যা উতপাদিত কারেন্ট এর বিপরীতে শক্তি প্রদান করে এবং শক্তির ক্ষয়করে”। একে একেবারে দূরকরা প্রায় অসম্ভব, তবে যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে।

কথা প্রসঙ্গে বলছি মোটর, রিলে, ট্রান্সফরমার বা যে কোনো তার দিয়ে প্যাঁচানো লোড কে ইন্ডকটিভ লোড বলে। এবং আমরা প্রায় সময়ই ইলেকট্রনিক্স সার্কিট সমূহে এই ব্যাক ইএমএফ থেকা বাঁচবার জন্য নিম্নরূপ সংযোগ দেখতে পাই-

মোটরের ব্যাক ইএমএফ থেকে বাঁচার জন্য ডায়োড ব্যবহার
মোটরের ব্যাক ইএমএফ থেকে বাঁচার জন্য ডায়োড ব্যবহার

এরফলে হয়কি মোটরের বা রিলের কয়েল থেকে সৃষ্ট ব্যাক ইএমএফ বা বিপরীত ভোল্টেজ সার্কিট এ দেখানো ট্রানজিস্টরে প্রবেশ করতে পারেনা। যারফলে ট্রানজিস্টর টি অতিরিক্ত গরম হবার হাতথেকে বাঁচে। ক্ষেত্র বিশেষে এই বিপরীত ভোল্টেজ সার্কিটের সাপ্লাই ভোল্টেজ থেকেও অনেক বেশী হয়ে যেতে পারে যা এই ডায়োড টি সার্কিট এ প্রবেশের হাত থেকে রক্ষাকরে, ফলে বাঁচে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ও দামী পার্টস। এখানে উল্লেখ্য যে ডায়োড টি ইন্ডাকটিভ লোডের সাপেক্ষে রিভার্স বায়াসে লাগাতে হবে।

শান্ট ওয়াইন্ডিং এবং সিরিজ ওয়াইন্ডিংঃ

এই দুইটি জিনিস প্রতিটি মোটর বা জেনারেটরে থাকবেই। আসলে এটি হছে এক প্রকারের কয়েল বা তারের প্যাঁচ। কিন্তু নামের ভিন্নতা কিসের জন্য? হ্যা সেটাই বলছি। প্র্যাক্টিকালি এবং সরাসরি বলতে গেলে বলতে হবে- যে কয়েলের তার গুলো চিকন কিন্তু অনেক গুলো প্যাঁচ থাকে তাকে শান্ট ওয়াইন্ডিং বা শান্টের প্যাঁচ বলে। এর বিশেষত্ব হল এর প্যাঁচ অনেক এবং তার গুলো অনেক সরু হয়। যারফলে এর মধ্যে দিয়ে খুব বেশি পরিমাণ কারেন্ট প্রবাহিত হতে পারে না, অর্থাৎ এর রেজিস্ট্যান্স বেশি থাকে।

আর অন্যদিকে সিরিজ ওয়াইন্ডিং বা সিরিজ প্যাঁচ পুরোপুরি এর উল্টো। মানে, এখানে প্যাঁচ কম থাকে। তারফলে যাহয় তাহল এর মধ্যে দিয়ে অনেক বেশি পরিমাণের কারেন্ট প্রবাহিত হতে পারে। নিচের চিত্র গুলো দেখলেই আপনাদের ধারণা এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে আশা করছি ।

শান্ট ওয়াইন্ডিং এবং সিরিজ ওয়াইন্ডিং
শান্ট ওয়াইন্ডিং এবং সিরিজ ওয়াইন্ডিং

মোটরের RPM/আরপিএম কিঃ

অনেক সময় অনেক ছোট মোটর থেকে বড় বিশাল আকৃতির মোটরের গায়ে এই জিনিস লেখা থাকে। কিন্তু এটা আমাদের কৌতূহলই থেকে যায়। আসলে এর মানে হচ্ছে- “কোন মোটর এক মিনিটে কত বার ঘূর্ণন সম্পন্ন করতে পারে”। সহজ কথায়, একটি মোটর পূর্ণগতি লাভ করার পর যদি কোন একটি নির্দিষ্ট এক মিনিট কে কেন্দ্র করে তার ঘূর্ণন পরিমান করা হয় তাহলে তার পরিমান কে আরপিএম(RPM) বা ঘূর্ণন প্রতি মিনিট বলে

অনেক সময় বিভিন্ন গাড়ির স্পেসিফিকেশনে বা মোটর সাইকেলের স্পেসিফিকেশনেও এই কথাটি লেখা থাকে। হয়ত তখন জানতাম না। কিন্তু এখন কিন্তু আমরা সবাই জানি এর আসল কথাটি কি বা এটি আসলে কি বুঝায়। এখন হয়ত সবাই সঠিক জিনিস চিনতে আর ভুল করব না।

ঠিক সেরকমই আমরা যে মোটর ব্যবহার করি তার গায়েও একই কথা লেখা থাকে। তারমানে যে মোটর এর আরপিএম যতবেশি তার ঘূর্ণন ক্ষমতা ততো বেশি হবে। কিছু জায়গায় আরপিএম এর স্থানে আরপিএস বা রেভোলুশন ব্যবহার করে থাকে। এটি দেখলেও ঘাবড়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই। এর মানেও একই, শুধু তারা ঘূর্ণন প্রতি মিনিটের জায়গায় প্রতি সেকেন্ড ব্যবহার করেছে। রেভোলুশন মানেও ঘুর্ণন।

ডিসি মোটরের এফিসিয়েন্সি বা লস সমূহঃ

আমরা একটি কথা সবাই জানি যে যেকোন মেশিনের ই আলাদা আলাদা এফিসিয়েন্সি বা আউটপুট ক্ষমতা থাকে। অর্থাৎ, একটি মেশিনের ইনপুট অনুযায়ী আউটপুটে কি রকম শক্তি পাচ্ছে তার হিসাবএপর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোন মেশিন আবিষ্কার হয় নি যা দিয়ে ১০০ ভাগ এফিসিয়েন্সি পাওয়া সম্ভব। মোটরও এর ভিন্ন কিছু নয়।

কিন্তু এই এফিসিয়েন্সি ইনপুটের তুলণায় কম হওয়ার কারণ কি আসুন তা এক নজরে জেনে নেই। ডিসি মোটরের লস বা ক্ষতি সমূহ কে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। তা হলঃ

  • ১। মোটরের কপার ক্ষতি
  • ২। মোটরের লোহার ক্ষতি
  • ৩। মোটরের মেকানিক্যাল ক্ষতি

তাছাড়াও আরও কিছু ক্ষতি বা লস আছে যেগুলো প্রায় সব মেশিনেই হয়ে থাকে যেমন শব্দ দূষন, ঘর্ষণ এর শক্তি, ব্যাক ভোল্টেজ (আগের কলামে উল্লিখিত)।

ডিসি মোটরের এফিসিয়েন্সি বা লস সমূহ
ডিসি মোটরের এফিসিয়েন্সি বা লস সমূহ

মোটরের স্টার্টারঃ

যেকোন ডিসি মোটরের ভিতরেই স্টার্টার নামের একটা অংশ বা পার্টস বসানো থাকে যার কাজ হল একটি নির্দিষ্ট ভোল্টেজে নিয়ে মোটরটিকে চালু করা। অর্থাৎ এর মধ্যে এমন এক ধরনের অটো ভেরিয়েবল রেজিস্ট্যান্স বসানো থাকে যার কাজ হলো ঐ নির্দিষ্ট ভোল্টেজে না পৌঁছা পর্যন্ত স্টার্টারটি মোটর কে চালু হতে দিবে না।ডিসি মোটরের ক্ষেত্রে এর অবদান অনেক।

ডিসি মোটরের ব্যবহারঃ

বাসাবাড়িতে সোলার প্যানেল কিংবা ব্যাটারি দিয়ে পানি তোলার জন্য, আধুনিক বিভিন্ন গাড়িতে, বিভিন্ন সুপার কারের বিশেষ অংশের পরিচালনার ক্ষেত্রে, লিফটের এস্কেলেটরে, রোবট, এছাড়াও আমরা ডিসি মোটর আরও অনেক কাজে ব্যবহার করে থাকি।

নিচের চিত্রে একটি রোবট আর্ম (Robot arm) দেখতে পাচ্ছেন যাকিনা আধুনিক শিল্পকারখানায় বহুল ভাবে ব্যবহৃত হয় ভারী কোনকিছু তুলতে। একে সচল রাখতে মোটরের ভূমিকা যে অপরিসীম তা বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন।

রোবট আর্মে ডিসি মোটরের ব্যবহার
রোবট আর্মে ডিসি মোটরের ব্যবহার

কেউ যদি পরীক্ষার জন্য কিংবা বিজ্ঞান প্রজেক্টের জন্য হাতে মোটর বানাতে চান তাহলে আমাদের সাইটে প্রকাশিত নিজেই বানাই ইলেকট্রিক মোটর লেখাটি পড়তে পারেন।

শেষ কথাঃ

বলতে বলতে অনেক কথাই হয়ে গেল। আশাকরি লেখা, ছবি ও ভিডিও সব মিলে পুরো বিষয় গুলো আপনাদের কে একটু হলেও শেয়ার করতে পেরেছি। আপনাদের হয়ত বা ভালো লেগেছে। যদি লেগেই থাকে তাহলে অনুগ্রহ পূর্বক লেখাটি শেয়ার করবেন। পরিশেষে বলতে চাই, আধুনিক সভ্যতাকে যেমন “চাকা অনেক অগ্রগামী করেছে তেমনি এই চাকাকে এগিয়ে নিয়েগেছে মোটরের গতি। ভেবে দেখুনতো মোটর আর জেনারেটর যদি আবিষ্কার নাহতো তাহলে কি এই লেখা আপনাদের সামনে নিয়ে আসতে পারতাম? অবশ্যই নয়। সামনে এমনি আরো অনেক লেখা নিয়ে আসবো সেই প্রত্যাশা করছি।

এই লেখা সম্পর্কে বা এই সাইটের যেকোন লেখা সম্পর্কে আমাদের কাছে কোন প্রশ্ন জানার থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। তাছাড়া ফেসবুকেও আমাদের পেজে লাইক দিয়ে সেখানেও বিভিন্ন প্রশ্ন করতে পারেন। সাথে থাকুন, ভালো থাকুন।

4 মন্তব্য

  1. মন্তব্য:ভাইয়া যদি বিভিন্ন প্রকার মোটরের কয়েল বাধার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সহ একটা টিউটোরিয়াল পোষ্ট করতেন তাহলে আশা করি অনেকের কাজে দিত। বিশেষ করে আমার।

  2. আমার মন্তব্য হচ্ছে পুল কাকে বলে পুলের হিসাব আমরা কি ভাবে করতে পারবো

উত্তর প্রদান

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন