ট্রায়াক, ডায়াক পরিচিতি ও ইলেকট্রনিক ফ্যান রেগুলেটরের কার্যপ্রণালী
ট্রায়াক, ডায়াক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে বহুল ব্যবহৃত হয়। ফ্যান রেগুলেটর, লাইট ডিমার, সুইচিং এর কাজে আমরা দৈনন্দিন ব্যবহার করি। আজকে এই ট্রায়াক নিয়েই লিখছি। সাথে সংক্ষিপ্ত আকারে ডায়াক সম্পর্কেও কিছু লিখবো। সেই সাথে ট্রায়াক দিয়ে ইলেকট্রনিক ফ্যান রেগুলেটরের কাজ নিয়েও সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি।
পরিচ্ছেদসমূহ
ট্রায়াক তিনটি তড়িৎদ্বার বা টার্মিনাল বিশিষ্ট একটি সুইচিং সেমিকন্ডাক্টর ইলেকট্রনিক ডিভাইস ৷ ট্রায়াক শুধুমাত্র তখনই পরিবাহী হয় যখন এর গেট (Gate) এ পজেটিভ অথবা নেগেটিভ ভোল্ট/পালস দ্বারা ট্রিগার করা হয়৷
এটি আগে ট্রায়োড ফর অল্টারনেটিং কারেন্ট (TrIode for Alternating Current) নামে সুপরিচিত ছিল যা কিনা SCR বা থাইরিস্টরের (thyristor) উন্নত ভার্শন। কিন্তু থাইরিস্টর (SCR) এর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এটি একমুখী অর্থাৎ ডিসি পাওয়ারকে অথবা AC এর লোডে ফরওয়ার্ড বায়াস যুক্ত হাফ-সাইকেলকে কন্ডাক্ট ও নিয়ন্ত্রন করতে পারে ৷ অপরদিকে ট্রায়াক এসি (AC) বা অল্টারনেটিং সাপ্লাইয়ের পজেটিভ ও নেগেটিভ উভয় হাফ-সাইকেলই কন্ডাক্ট ও নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম।
ট্রায়াক ১৯৬৩ সালে আবিষ্কার হয়। এর মূল ধারণাটি আবিষ্কার করেন বিল গুজউইলার (Bill Gutzwiller) এবং নির্মাণ করেন গর্ডন হল (Gordon Hall)। মোট তিনটি ধাপে এর আবিষ্কার সম্পন্ন হয়। তথ্যসূত্রঃ http://www.edisontechcenter.org/semiconductors.html এবং https://sites.google.com/site/transistorhistory/Home/us-semiconductor-manufacturers/general-electric-history
নিচে বহুল ভাবে ট্রায়াক ব্যবহৃত হয় এমন কয়েকটি ডিভাইসের নাম উল্লেখ করছি-
নিচের ছবিতে এর সিম্বল দেখতে পাচ্ছেন-
ট্রায়াক এর তিনটি টার্মিনাল আছে, যথা-
MT1 এবং MT2 ব্যবহার করা হয় ফেজ এবং নিউট্রাল লাইনে সংযোগ দেবার জন্য। অন্যদিকে Gate ব্যবহার করা হয় ট্রিগারিং এর জন্য। ক্ষেত্রবিশেষে এই টার্মিনাল গুলোকে A1, A2, T1, T2 প্রভৃতি নামেও অভিহিত করা হয়।
এটি প্রকৃতপক্ষে থাইরিস্টর/এসসিআর এর উপর ভিত্তি করেই...দ্বি-মুখী সুইচিং এর জন্য দুটি SCR কে পরস্পর বিপরীত মুখী সংযোগের মাধ্যমে ট্রায়াক তৈরি হয়েছে । ট্রায়াক ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম এর জন্য এসি সুইচিং প্রদান করে থাকে। থাইরিস্টর এর মত এটি বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমে সুইচিং এর কাজে ব্যবহার করা হয়। থাইরিস্টর ডিসিতে এবং AC এর হাফ-সাইকেলে কাজ করে ৷ কিন্তু ট্রায়াক এসি(AC) পজেটিভ ও নেগেটিভ উভয় হাফ সাইকেলে কাজ করতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে ট্রায়াক হল ২টি এসসিআর (SCR) এর সমতুল্য।
ট্রায়াকের বিভিন্ন ব্যবহার রয়েছে লাইট ডিমার, ফ্যান রেগুলেটর,মোটরের গতি নিয়ন্ত্রন, বিভিন্ন AC ডিভাইসের কারেন্ট নিয়ন্ত্রন সহ আরও অনেক কিছুতে।
সাধারণত ট্রায়েকে ৪ ধরনের ট্রিগারিং সম্ভবঃ-
এসি সুইচিং এর জন্য ট্রায়াক একটি আদর্শ ডিভাইস। কারন এটি একটি আল্টারনেটিং সাইকেল এর উভয় অর্ধেক অর্থাৎ পজেটিভ হাফ ও নেগটিভ হাফ সাইকেল এ প্রবাহিত হওয়া কারেন্টকে কন্ট্রোল করতে পারে। কিন্তু একটি থাইরিস্টর (SCR) দিয়ে শুধুমাত্র যেকোন একটি সাইকেল নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
নিচের চিত্র থেকে আমরা দেখতে পাই যে থাইরিস্টর দিয়ে অবশিষ্ট অর্ধেক সময়ে কোন প্রবাহ ঘটে না তাই অর্ধেক ওয়েভ সাইকেল কে কন্ডাক্ট করা যায়। অপরদিকে ট্রায়াকের ক্ষেত্রে উভয় অর্ধেক ওয়েভ সাইকেল কেই কন্ডাক্ট করানো সম্ভব। নিচের চিত্র লক্ষ করলে বিষয়টি বুঝতে আশাকরি সহজ হবে-
ফ্যান রেগুলেটর সার্কিট এ ব্যবহৃত ট্রায়াক এর গেটে ট্রিগারিং পালসের ওয়াইডথ (Pulse Width) কন্ট্রোল করবার জন্য পটেনশিও মিটার/ভেরিয়েবেল রেজিস্টর ব্যবহার করা হয়।
নিচে একটি ইলেকট্রনিক এসি ফ্যান রেগুলেটরের আভ্যন্তরীণ ছবি দেখতে পাচ্ছেন-
রেগুলেটরের কার্যপ্রণালীঃ ট্রায়াক এর গেটে ক্যাপাসিটর এর ডিসচার্জ এর পরিমান কম-বেশি হয়ে গেট ট্রিগার পালসের ওয়াইডথ্ (Pulse Width) কম-বেশী করে দেয়। এছাড়া সার্কিট এ একটি ডায়াক ও ব্যবহার করা হয়, যার কাজ হল ট্রায়াক এর গেট এ ট্রিগারিং পালস দেওয়া।
মূলত এই ধরনের ইলেকট্রনিক ফ্যান রেগুলেটর গুলোতে ভেরিয়েবল রেজিস্টর ও ক্যাপাসিটর মিলে একটি RC Timer সার্কিট তৈরি করে যার মূল কাজ হচ্ছে ভেরিয়েবল রেজিস্টরের মান অনুযায়ী ডায়াকের মাধ্যমে ট্রিগারিং পালস কে ট্রায়াকে পাঠানো।
ভেরিয়েবলের মান বেশি থাকলে ক্যাপাসিটর টি ধীরে ধীরে চার্জ হয় ফলে ট্রিগারিং পালসের ওয়াইডথ (প্রসস্থতা) কমে কিছুটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে ট্রিগার পালস ডায়াকের মাধ্যমে গেটে যায়। তাই ফ্যানের গতি কম হয়।
অপরদিকে পটেনশিও মিটার বা ভেরিয়েবলটির মান কমিয়ে দিলে ক্যাপাসিটর খুব দ্রুত চার্জ হয়ে ট্রিগার পালসের ওয়াইডথ বাড়িয়ে দিয়ে ট্রিগারিং পালসকে ডায়াকের মাধ্যমে দ্রুত ট্রায়াকের গেট পিনে পাঠিয়ে দেয়। এতে ট্রায়াকটি দ্রুত অন হয়। যার ফলেই ফ্যান জোরে ঘুরে বা লাইট উজ্জ্বল ভাবে জ্বলে। এবার ডায়াক সমন্ধে জানবো।
ডায়াক (Diac) হচ্ছে ২ টার্মিনাল বিশিষ্ট একপ্রকার ট্রিগারিং ডিভাইস যা নির্দিষ্ট ব্রেকডাউন ভোল্টেজে পৌঁছালে এটি কন্ডাক্ট করে ৷ ডায়াকের দুটো টার্মিনালই পরস্পরের মধ্যে ডিরেকশন পরিবর্তন করে উভয় হাফ সাইকেলেই এনোড বা ক্যাথোড হিসেবে কাজ করে ট্রিগার করতে পারে৷ নিচে ডায়াকের সিম্বল দেখতে পাচ্ছি-
সহজ ভাবে বললে জেনার ডায়োডের যেমন নির্দিষ্ট ব্রেকডাউন ভোল্টেজ থাকে (3.6V, 5.6V, 9.6V, 12V) তেমনি ডায়াকের ও এমনি একটি ভোল্টেজ সীমা থাকে যে ভোল্টেজে সীমায় পৌঁছালে সেটি কন্ডাক্ট করতে শুরু করে। তবে জেনার ডায়োড শুধু ডিসি তেই কাজ করে কিন্তু ডায়াক এসি তেও কাজ করতে পারে। আর ডায়াকের ব্রেকডাউন ভোল্টেজ সাধারণত 30 volt এর উপরে হয়।
কিছু জনপ্রিয় ডায়াকের নাম্বার- DB3, DB4, DB3A, DB6 ইত্যাদি। নিচে জনপ্রিয় একটি ডায়াক DB3/DB697 এর সত্যিকারের চিত্র দেখতে পাচ্ছি। এটির আকৃতি মাত্র ৩ মিলি মিটার যা কিনা সাধারন 1N4148 ডায়োডের আকৃতির মতোই।
জনপ্রিয় ডায়াক DB3 এর আসল ছবি
উপরে প্রদত্ত ইলেকট্রনিক ফ্যান রেগুলেটরের যে ডায়াগ্রাম টি দিয়েছি সেটি আমি Proteus সফটওয়্যার দিয়ে সিমুলেশন করে দেখছি আসলে এটি কিভাবে এসি ভোল্টেজকে কন্ট্রোল করে। এখানে পটেনশিও মিটার এর ভেলু কমিয়ে-বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দেওয়া যায় যে কতক্ষণ পর ট্রায়াক এর গেট এ ট্রিগার হবে। ট্রিগার এর পর থেকেই আমরা আঊটপুট এ ভোল্টেজ পাব। আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে নিচে সিমুলেশান এর একটি চিত্র দেওয়া হল। আশা করি চিত্রটি দেখলে বিষয়টা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আপনারা চাইলে লিংক থেকে সিমুলেশান ফাইলটি ডাউনলোড করে নিতে পারেন। ডাউনলোড লিংক
আশা করি উপরের পয়েন্ট গুলো থেকে ট্রায়াক সম্পর্কে আপনাদের মোটামুটি একটা ধারনা হয়েছে। এখন আমরা শিখব ট্রায়াক ব্যবহার করে কিভাবে এসি ফেজ কন্ট্রোল করা যায়। এটি আমরা দুই ভাবে করতে পারি
সাধারন পদ্ধতির একটা উদাহরণ আমি আগেই দিয়ে ফেলছি (ফ্যান রেগুলেটর)। অন্যটি হচ্ছে আমরা UJT(ইউজেটি) ট্রিগারিং সার্কিট ব্যবহার করে ট্রায়াক এর গেট এ ট্রিগার দিতে পারি এবং কতক্ষণ পর ট্রিগারটি হবে সেটা ট্রিগারিং সার্কিট এর রেজিস্টর (R) এবং ক্যাপাসিটর (C) এর মানের উপর নির্ভর করবে।
অন্যদিকে আমরা যদি এটা মাইক্রোকন্ট্রোলার এর সাহায্যে করতে চাই তাহলে প্রথমেই আমাদের দরকার হবে জিরো ক্রস (Zero Cross) ডিটেক্টর সার্কিট এর। তার আগে আমাদেরকে বুঝতে হবে এসি তে জিরো ক্রসিং কি জিনিস। কারন ট্রায়াকের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
যখন একটি সাইন ওয়েভ পজেটিভ হাফ সাইকেল থেকে নেগেটিভ হাফ সাইকেলে আথবা নেগেটিভ হাফ সাইকেল থেকে পজেটিভ হাফ সাইকেলে স্থানান্তরিত হয় তখন শূন্য (Zero) ভোল্টেজ অতিক্রম করে। এই শূন্য ভোল্টেজ অতিক্রম করাটা যে সার্কিট এর সাহায্যে নির্ণয় করা হয় তাকে জিরো ক্রস (Zero Cross) ডিটেক্টর সার্কিট বলে।
জিরো ক্রস (Zero Cross) ডিটেক্টর সার্কিট অনেক ভাবেই করা যায় যেমনঃ-
ইন্টারনেট এ সার্চ করলে জিরো ক্রস (Zero Cross) ডিটেক্টর এর অনেক সার্কিট পাওয়া যাবে। নিচে এমনি একটি সার্কিট ও MOC আইসি এর চিত্র দেয়া হলো-
এখন কাজের কথায় আসি, মাইক্রোকন্ট্রোলার এর সাহায্যে কীভাবে আমরা ফেজ কন্ট্রোল করব। এই পোস্টটিতে এটা নিয়ে আমি খুব সংক্ষেপে লিখছি।
ট্রায়াকের গেটে ট্রিগারিং টাইম ডিলে যত বেশি হবে আউটপুট এ আমরা ততই কম ভোল্টেজ পাব। এই ট্রিগারিং টাইম এরও একটা লিমিট আছে যা এই পোস্টে যুক্ত করে লেখা আর বড় করছি না। পরবর্তী মাইক্রোকন্ট্রোলার নিয়ন্ত্রিত এসি ফেজ কন্ট্রোল বা ফ্যান রেগুলেটর সংক্রান্ত পোস্টে সব কিছু বর্ণনা দেব। এবং আমার বানানো ট্রায়াক দিয়ে ফ্যান স্পিড কন্ট্রোলার বা লাইট ডিমার দেখাবো। আশাকরি ট্রায়াক ও ডায়াকের মুল কার্যপ্রণালী সেই সাথে ইলেকট্রনিক ফ্যান রেগুলেটরের কার্যপ্রণালী কিছুটা হলেও তুলে ধরতে পেরেছি। সবাই ভালো থাকবেন।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ লুতফর রহমান বাবুল ভাই ও সৈয়েদ রাইয়ান ভাই
This post was last modified on May 25, 2017 12:20 am
করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে আপনাদের বলার মত কিছু নেই। এটি যেকোনো জায়গায় থাকতে পারে এবং…
সকল বন্ধুদের স্বাগতম আমার আরডুইনো দিয়ে স্ক্রলিং এলইডি মেসেজ ডিসপ্লে প্রজেক্টে। এটা খুবই মজার একটি প্রজেক্ট।…
ড্রিল বিট এর ধার দ্রুত ক্ষয়ে যায়। পিসিবি ড্রিল মেশিন গুলোতে ব্যবহৃত বিট গুলোকে চাইলে…
ভূমিকা পাওয়ার ট্রান্সফরমার তৈরী করতে চান অনেকেই। এই লেখার মাধ্যমে এটি তৈরী করবার প্রয়োজনীয় ক্যালকুলেশন…
কোড লক সিকিউরিটি সুইচ আমরা প্রায়ই মুভিতে দেখি। যেখানে নির্দিষ্ট কোড ঢুকানোর পর কোন সুইচ…
মাল্টিমিটার দিয়ে কিভাবে কোনো ট্রানজিস্টর এর বেজ, ইমিটার ও কালেক্টর (Base, Emitter & Collector) বের…
This website uses cookies.
কমেন্ট দেখুন
খুবই সুন্দর & সময় উপযোগী লেখা। অসংখ্য ধন্যবাদ লেখার জন্য। মাইক্রোকন্ট্রোলার নিয়ন্ত্রিত এসি ফেজ কন্ট্রোল বা ফ্যান রেগুলেটর সংক্রান্ত পোষ্ট দ্রুত আসা করছি।
আপনার মূল্যবান সময় ব্যায় করে লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
আশা করি কিছু দিনের মধ্যে ফ্যান রেগুলেটর সংক্রান্ত পোস্টটি পাবলিশ করা হবে।
অনেক তথ্যবহুল লেখা :D ধন্যবাদ লেখার জন্য। :)
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ মূল্যবান সময় ব্যায় করে লেখাটি পড়ার জন্য।
উপকৃত হলাম
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে
খুবই ভালো লাগলো আপনাদের শিক্ষানীয় বিষয় গুলো, ধন্যবাদ আপনাদের